You are currently viewing ডিমেনশিয়া কী, এর ভুল ধারণা এবং প্রতিরোধের উপায়

ডিমেনশিয়া কী, এর ভুল ধারণা এবং প্রতিরোধের উপায়

ডিমেনশিয়া নামটা শুনলেই কেমন যেন ভয় লাগে, তাই না? অনেকে ভাবেন, বুড়ো বয়সে মনে না রাখতে পারা মানেই ডিমেনশিয়া।

কিন্তু এটা সঠিক ধারণা নয়। 

ডিমেনশিয়া নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা আছে। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে আমাদের খাওয়া-দাওয়া আর জীবনযাপন এই রোগ থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে। তাই আমরা এই আর্টিকেলে সহজ ভাষায় জানব ডিমেনশিয়া কী, এর লক্ষণগুলো, কিছু ভুল ধারণা আর কিভাবে ভালো খাবার ও জীবনযাপন করে আমরা এই রোগ দূরে রাখতে পারি।

ডিমেনশিয়া আসলে কী?

ডিমেনশিয়া কোনো রোগ না, এটা আসলে অনেকগুলো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের একটা সমষ্টি।

সহজ করে বললে, যখন একজন মানুষের চিন্তাশক্তি, স্মৃতি, কথা বলা আর  প্রতিদিনের কাজ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তখন আমরা সেটাকে ডিমেনশিয়া বলি।

সাধারণত ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের এটা বেশি হয়, তবে কম বয়সীদেরও হতে পারে, যদিও সেটা খুব কম দেখা যায়।

এটা শুধু স্মৃতি হারানোর রোগ না,এটি আমাদের মন, ব্যবহার, যুক্তি এবং ভাষাকেও প্রভাবিত করে। ডিমেনশিয়া খুব ধীরে ধীরে শুরু হয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর খারাপ প্রভাব বাড়তে থাকে।

সারা বিশ্বে এখন বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাই ডিমেনশিয়াও একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের দেশেও বয়স্ক মানুষ বাড়ছে, আর সেই কারণে ডিমেনশিয়া রোগীও বাড়ছে।বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রতি ১২ জনের মধ্যে একজনের ডিমেনশিয়া রয়েছে, যা প্রায় ৮ শতাংশ

ডিমেনশিয়ার কিছু ভুল ধারণা:

অনেকের মনে হয় বয়স বাড়লেই ডিমেনশিয়া হবে, কিন্তু এটা ঠিক না। বয়স একটা কারণ হতে পারে, তবে একমাত্র কারণ নয়। পারিবারিক ইতিহাস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর আমাদের জীবনযাপনও এর জন্য দায়ী হতে পারে।

আবার অনেকে মনে করেন মানসিক চাপ বা ডিপ্রেশন থাকলে ডিমেনশিয়া হবে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে এটাও  সত্যি না। তবে হ্যাঁ, বেশি মানসিক চাপ আর ডিপ্রেশন থাকলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ঘুমের সমস্যাও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

আরেকটা ভুল ধারণা হল ডিমেনশিয়া মানে শুধু স্মৃতি হারানো, কিন্তু আসলে এটা মানুষের ব্যবহার, কথা বলা আর যুক্তির ক্ষমতাকেও নষ্ট করে দেয়। অনেক সময় ডিমেনশিয়া রোগীরা শুরুতে স্মৃতি ঠিক রাখতে পারেন, কিন্তু কোনো সমস্যা সমাধান করতে বা যুক্তি দিতে সমস্যায় পড়েন।

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে খাবারের ভূমিকা:

আমরা যা খাই, তার প্রভাব আমাদের শরীরের সাথে সাথে আমাদের মস্তিষ্কের উপরও পড়ে। কিছু খাবার আছে যা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুব ভালো এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

যেমন সবুজ শাকসবজি (পালং শাক, কলমি শাক), বেরি (স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি), বাদাম (আখরোট, কাঠবাদাম), ওমেগা-৩ যুক্ত মাছ (স্যামন, টুনা), অলিভ অয়েল, আর গোটা শস্য (ওটস, ব্রাউন রাইস)। এই খাবারগুলো আমাদের মস্তিষ্কের কোষকে শক্তিশালী করে আর মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ভালো রাখে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আর ওমেগা-৩ আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই দরকারি। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষতিকর জিনিস থেকে আমাদের কোষকে বাঁচায়, আর ওমেগা-৩ মস্তিষ্কের গঠন আর কাজকে উন্নত করে। এমনকি যারা মধ্য বয়সেও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ শুরু করেন, তাদেরও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

চিনি আর ফ্যাট যুক্ত খাবার বেশি খেলে তা মস্তিষ্কের জন্য খারাপ হতে পারে। অতিরিক্ত চিনি ইনসুলিন রেজিস্টেন্স বাড়াতে পারে, যা অ্যালঝেইমারের ঝুঁকি বাড়ায়। ফাস্ট ফুড ও প্রসেসড ফুড মস্তিষ্কের ব্যাথা বাড়াতে পারে।

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে কেমন জীবনযাপন করা উচিত?

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে শুধু ভালো খাবার খেলেই হবে না, সুস্থ জীবনযাপনও জরুরি। নিম্নে কিছু বিষয়ে আলোচনা করা হলো :

  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন ব্যায়াম করলে শরীর,মন দুটোই ভালো থাকে এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমে। রোজ অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করা ভালো। ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়ে, যা মস্তিষ্কের কোষকে অক্সিজেন সরবরাহ করে।
  • মনকে সচল রাখা:আমাদের মনকে সচল রাখাটাও খুব জরুরি। নতুন কিছু শেখা, বই পড়া, ধাঁধা মেলানো, ছবি আঁকা, গান শোনা, বন্ধুদের সাথে গল্প করা – এগুলো মস্তিষ্ককে সচল রাখে।
  • সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা: বয়স হলে একা থাকাটা ঠিক না, বন্ধু আর পরিবারের সাথে থাকাটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব দরকারি। সামাজিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত থাকলে মন ভালো থাকে এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম: ঘুম আমাদের মস্তিষ্কের জন্য বিশ্রামের সময়। রোজ ৭-৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম না হলে মস্তিষ্কের কাজকর্মে সমস্যা হতে পারে এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ঘুমের অভাব হলে মনোযোগ আর স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে।
  • ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার: ধূমপান আর মদ্যপান দুটোই মস্তিষ্কের জন্য খুব খারাপ। ধূমপান মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয় আর মদ্যপান মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট করে। তাই এগুলো থেকে দূরে থাকা উচিত। ধূমপান ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আর কোলেস্টেরল ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ ডিমেনশিয়া রোগী রোগ নির্ণয়ের জন্য লক্ষণ প্রকাশের দুই বছর পর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তাই বছরে একবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। আর যদি ডিমেনশিয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় (যেমন বারবার জিনিস ভুলে যাওয়া, পরিচিত লোকেদের চিনতে সমস্যা হওয়া), তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ:পরিবারের লোকজন আর যারা রোগীর যত্ন নেন, তাদেরও ধৈর্য আর ভালোবাসা নিয়ে রোগীদের পাশে থাকা উচিত। ডিমেনশিয়া রোগীদের জন্য সহানুভূতি আর সঠিক পরিচর্যা খুবই জরুরি। তাদের মনে সাহস যোগানো এবং তাদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করা দরকার।

সরকার আর বিভিন্ন সংস্থাকেও ডিমেনশিয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে এবং রোগীদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। ডিমেনশিয়া সাপোর্ট সেন্টার এবং হেল্পলাইন তৈরি করা দরকার।

সচেতন জীবনই প্রতিরোধের চাবিকাঠি:

ডিমেনশিয়া একটা কঠিন রোগ, কিন্তু সঠিক জীবনযাপন, ভালো খাবার আর নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তাই ভয় না পেয়ে আসুন, আমরা সবাই মিলে সচেতন হই এবং সুস্থ জীবন যাপন করি। মনে রাখবেন, সচেতনতাই হলো ডিমেনশিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।